ব্যবসার প্রথম ডকুমেন্ট হচ্ছে ট্রেড লাইসেন্স। এই লাইসেন্স উদ্যোক্তাদের আবেদনের ভিত্তিতে প্রদান করা হয়ে থাকে। ট্রেড লাইসেন্স মানে ব্যবসার অনুমতিপত্র। ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা পরিচালনা করা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। যে কোনো ব্যবসা করতে হলে আগে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়। ১৯৮৬ সালের মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন ট্যাক্সেশন বিধিমালার ৪৪(১) বিধি অনুসারে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে চাইলে অবশ্যই ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে। ব্যবসা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহারযোগ্য নয়।
সাধারণত সিটি করপোরেশন ও মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা বা জেলা পরিষদ এই লাইসেন্স প্রদান করে থাকে।আপনি যেই ব্যবসাই করুন না কেন ট্রেড লাইসেন্স অবশ্যই করতে হবে।
কোথা থেকে ট্রেড লাইসেন্স করতে হয় ?
সিটি করর্পোরেশন,পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে এই লাইসেন্স প্রদান করা হয়। আপনি সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদ অফিস, সিটি কর্পোরেশন অথবা পৌরসভায় গিয়ে ট্রেড লাইসেন্স বানাতে পারেন। যে অঞ্চলে ব্যবসা করবেন, সেই অঞ্চলের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের (ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন) কাছ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে।
ঢাকায় কীভাবে আবেদন করবেন?
ঢাকা সিটি করপোরেশন (উত্তর ও দক্ষিণ) তার নাগরিকদের সেবা দেওয়ার জন্য সিটি করপোরেশনকে কতগুলো অঞ্চলে বিভক্ত করেছে। এর মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশনের পাঁচটি এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পাঁচটি অঞ্চল রয়েছে। আপনার প্রতিষ্ঠানটি যে অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত, ওই অঞ্চলের অফিস থেকেই লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হবে।
ট্রেড লাইসেন্সের জন্য সিটি করপোরেশনের দুই ধরনের ফরম রয়েছে। আপনি যে ধরনের ব্যবসা করছেন বা করতে ইচ্ছুক, তার ওপর ভিত্তি করে ফরম নেবেন। ফরম পূরণ করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ছবি জমা দিয়ে মূল ট্রেড লাইসেন্স বই সংগ্রহ করতে হবে। সিটি করপোরেশনের দ্বারা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তদন্ত হতে পারে এবং এর প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট পরিমাণ লাইসেন্স ফি পরিশোধের মাধ্যমে লাইসেন্স দেওয়া হবে।
কারা ট্রেড লাইসেন্স করতে পারবেন ?
নারী, পুরুষ উভয়ই ট্রেড লাইসেন্স করতে পারবেন তবে অবশ্যই তাকে কোনো না কোনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকতে হবে। বয়স ১৮ বছরের উপরে হতে হবে।
ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহের জন্য দুটি ভিন্ন ধরনের ফরম আছে। ‘আই ফরম’ ও ‘কে ফরম’ নামে চিহ্নিত প্রতিটি ফরমের দাম ১০ টাকা। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যদি ছোট বা সাধারণ হয়, তবে ‘ফরম আই’ আর বড় ব্যবসার ক্ষেত্রে ‘কে ফরম’ নিতে হয়। আপনার প্রতিষ্ঠানটি যে অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত, ওই অঞ্চলের অফিস থেকেই লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হবে।
কত টাকা ও কত দিন লাগে?
লাইসেন্স ফি ব্যবসার ধরনের ওপর নির্ভর করে কমবেশি হতে পারে। এই ফি সংশ্লিষ্ট অফিসে রসিদের মাধ্যমে জমা দিতে হবে। লাইসেন্স ফি সর্বনিম্ন ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। একটি লাইসেন্স পেতে তিন থেকে সাত দিন সময় লাগতে পারে।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
• ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের স্থানটি নিজের হলে সিটি করপোরেশনের হালনাগাদ করের রশিদ এবং ভাড়ায় হলে ভাড়ার চুক্তিনামা বা রশিদ আবেদনপত্রের সঙ্গে দাখিল করতে হবে।
• আবেদনপত্রের সঙ্গে তিন কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নির্ধারিত নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা দাখিল করতে হবে।
• জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি
• TIN সার্টিফিকেট
• বাড়ির ইউটিলিটি বিলের কপি
• যে বাড়িতে ব্যবসায় পরিচালনা করছেন তার হোল্ডিং ট্যাক্স হালনাগাদ করণের রশিদ
• প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি লিমিটেড হলে মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেলস ও সার্টিফিকেট অব ইনকরপোরেশন দিতে হবে। আর পার্টনারশিপ ব্যবসার ক্ষেত্রে পার্টনারশিপ ডিডের কপি দিতে হবে।
• যদি কারখানা দিতে চান: প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠান, কারখানা বা কোম্পানির পার্শ্ববর্তী অবস্থান বা স্থাপনার নকশাসহ ওই স্থাপনার মালিকের অনাপত্তিনামাও দাখিল করতে হবে।
এসব ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য বিভিন্ন কাগজপত্র জমা দিতে হয়। যেমন-
• সাধারণ ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্সের ক্ষেত্রে দোকান ভাড়ার চুক্তিপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি, নিজের দোকান হলে ইউটিলিটি বিল এবং হালনাগাদ হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের ফটোকপি। আবেদনকারীর ৩ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
• ব্যবসা যদি যৌথভাবে পরিচালিত হয় তাহলে ১৫০/৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে পার্টনার শিপের অঙ্গীকারনামা/শর্তাবলী জমা দিতে হবে।
• অস্ত্র ও গোলাবারুদের ক্ষেত্রে অস্ত্রের লাইসেন্স।
• ওষুধ ও মাদকদ্রব্যের ক্ষেত্রে ড্রাগ লাইসেন্সের কপি।
• শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ওপরের সব দলিলের সঙ্গে পরিবেশসংক্রান্ত অনাপত্তিপত্র, প্রতিষ্ঠানের অবস্থান চিহ্নিত মানচিত্র ও অগ্নিনির্বাপণ প্রস্তুতিসংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্র দিতে হবে।
• ক্লিনিক/প্রাইভেট হাসপাতালের ক্ষেত্রে ডিরেক্টর জেনারেল স্বাস্থ্য অধিদফতর কর্তৃক অনুমতিপত্র।
• প্রিন্টিং প্রেস/ছাপাখানা ও আবাসিক হোটেলের ক্ষেত্রে ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক অনুমতিপত্র।
• রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য মানবসম্পদ রপ্তানি ব্যুরো কর্তৃক প্রদত্ত লাইসেন্স।
• ট্রাভেল এজেন্সির ক্ষেত্রে সিভিল এ্যাভিয়েশনের অনুমতিপত্র।
• সিএনজি স্টেশন বা দাহ্য পদার্থের ক্ষেত্রে বিস্ফোরক অধিদপ্তর বা ফায়ার সার্ভিস ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র।
• ফ্যাক্টরি/কারখানার ট্রেড লাইসেন্সের ক্ষেত্রে পরিবেশের ছাড়পত্রের কপি। প্রস্তাবিত ফ্যাক্টরি/কারখানার পার্শ্ববর্তী অবস্থান/স্থাপনার বিবরণসহ নকশা/লোকেশন ম্যাপ। প্রস্তাবিত ফ্যাক্টরি/কারখানার পার্শ্ববর্তী অবস্থান/স্থাপনার মালিকের অনাপত্তিনামা। ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নিয়ম-কানুন মেনে চলার অঙ্গীকারনামা ১৫০/৩০০ টাকার জুডিশিয়ার স্ট্যাম্পে স্বাক্ষরিত।
লাইসেন্স নবায়ন
লাইসেন্স নবায়ন একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। একটি লাইসেন্সের মেয়াদ এক বছর এবং এর মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে আবেদন করতে হবে।
• পূর্বের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত আঞ্চলিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
• দায়িত্বপ্রাপ্ত আঞ্চলিক কর বিষয়ক কর্মকর্তা নবায়নকৃত ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করবেন।
• লাইসেন্স নবায়ন ফি নতুন লাইসেন্সের সমপরিমাণ। এই ফি আগের মতোই লাইসেন্স ফরমে উল্লিখিত ব্যাংকে প্রদান করতে হয়।
লাইসেন্স বাতিল
মিথ্যা বা অসম্পূর্ণ তথ্য দিলে, লাইসেন্সে উল্লিখিত শর্তাবলি এবং সিটি করপোরেশনের আইন ও বিধি মেনে না চললে লাইসেন্স বাতিল হতে পারে। এ ছাড়া লাইসেন্স গ্রহীতার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। তবে যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আগে গ্রহীতাকে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিতে হবে।
আইনগত বিধিমালা
একটি ট্রেড লাইসেন্স একাধিক ব্যবসায় ব্যবহার করা যায় না। একটি ট্রেড লাইসেন্স শুধু একটি ব্যবসার জন্যই প্রযোজ্য। অর্থাৎ যে ব্যবসা পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্সটি করা হয় শুধু সেই ব্যবসা পরিচালনার জন্য ব্যবহার করা যাবে অন্য কোনো ধরনের ব্যবসার জন্য ব্যবহার করা যাবে না। নতুন কোনো ব্যবসা শুরু করলে তার জন্য নতুন ট্রেড লাইসেন্স করতে হবে।
একটি ট্রেড লাইসেন্স একাধিক ব্যক্তিও ব্যবহার করতে পারবেন না। একটি ট্রেড লাইসেন্স শুধু একজন ব্যবসায়ী/উদ্যোক্তা ব্যবহার করতে পারবেন। অর্থাৎ যে ব্যবসায়ী/উদ্যোক্তার নামে ট্রেড লাইসেন্সটি করা হয়েছে এটি শুধু তার জন্যই প্রযোজ্য। এটা কোনোভাবেই হস্তান্তরযোগ্য নয়।
সংযুক্ত তথ্যাদি সরকারী প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যেকোন সরকারি সিদ্ধান্তের পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজনের কারণে এই তথ্যগুলো অকার্যকর বিবেচিত হতে পারে।