করোনার পর নতুন পৃথিবী কেমন হবে?

মানবজীবনে মহামারী নতুন কিছু নয়; মানুষ আক্রান্ত হয়েছে বারবার আবার তা মোকাবেলা করে উঠে দাঁড়িয়েছে, এগিয়ে নিয়ে গেছে সভ্যতাকে। ১৪ শতকে বিশ্বে, বিশেষ করে ইউরোপে বিউবোনিক প্লেগ মহামারী আকারে দেখা দিয়েছিল। ইউরোপের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ প্লেগ সংক্রমণে মারা যায়, এক-তৃতীয়াংশ লোক ইউরোপ থেকে পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়, আর এক-তৃতীয়াংশ থেকে যায়। ১৩৪৭ থেকে ১৩৫১ সাল ধরে চলতে থাকা প্লেগের আক্রমণে সাড়ে সাত কোটি থেকে ২০ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ইতিহাসে এ মহামারীকে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অনুমান করা হয়, বিশ্ব জনসংখ্যা ৪৭ কোটি থেকে ৪০ কোটিরও নিচে নেমে এসেছিল।

আগের জনসংখ্যায় ফিরে আসতে ২০০ বছর সময় লেগেছিল। ১৭২০ সালে প্লেগ ‘গ্রেট প্লেগ মারসেইলি’ নাম নিয়ে আবারও পৃথিবীর মানুষকে আক্রমণ করে। আক্রান্ত হয় মূলত ইউরোপ। অনুমান করা হয়, সেসময়ে প্রায় ১ লাখ মানুষ প্রাণ হারায় (কোনো কোনো মাধ্যম এ অঙ্কটাকে ৪ কোটি বলছে)। লক্ষণগুলো ছিল জ্বর, মাথাব্যথা আর শারীরিক দুর্বলতা। বিগত শতকগুলোয় প্লেগের দৌরাত্ম্য আর তেমন দেখা যায়নি। তবে ১৯৯৪ সালের ২৬ আগস্ট থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ভারতে এ প্লেগ আবারও হানা দিয়েছিল। তাতে ৬৯৩ জন আক্রান্তের মধ্যে ৫৬ জন মারা যায়।

মাছির কামড় বা সংক্রমিত প্রাণীর, বিশেষ করে ইঁদুর দ্বারা বায়ুর মাধ্যমে ছড়ানো এ রোগের প্রকোপ আবারও ২০০৭ সালে সামান্য মাত্রায় দেখা গিয়েছিল কঙ্গো, মাদাগাস্কার ও পেরুতে। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রামাঞ্চলে নাকি এখনও এর যৎসামান্য উঁকিঝুঁকি দেখা যায়। তবে সারা বিশ্ব এখন আর প্লেগের ভয়ে আতঙ্কিত নয়, এটি অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা নিরাময়যোগ্য।

প্লেগের আতঙ্ক থেকে পৃথিবীর মানুষ মুক্ত হলেও মহামারী তার পিছু ছাড়েনি। ১৮২০ সালে চীন, রাশিয়া, ভারতসহ সারা বিশ্ব আক্রান্ত হয় কলেরায়। সেসময়েও ১ লাখ মানুষের মৃত্যুর কথা শোনা যায় (তবে কোনো কোনো মাধ্যম বলছে ৫ কোটি)। কলেরার ১০০ বছর পর ১৯২০ সালে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটায় ‘স্প্যানিশ ফ্লু’। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় এর প্রাদুর্ভাব বেশি ছিল। প্রায় ৫০ কোটি আক্রান্তের মধ্যে ১০ কোটি মানুষ মারা যায়, অর্থাৎ প্রাণহানির হার ২০ শতাংশ।

‘স্প্যানিশ ফ্লু’র দিনগুলো ১০০ বছর পার করে এখন ২০২০। ৫০০ বছরের আগের পৃথিবীর সঙ্গে আজকের পৃথিবীর তুলনা চলে না। এটি জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মহা উৎকর্ষের যুগ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের হয়েছে অভাবনীয় উন্নতি; গণ ও যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে তৈরি হয়েছে সর্বসাধারণের অধিকতর সচেতন হওয়ার সুযোগ। এতকিছুর পরও করোনাভাইরাস সারা বিশ্বের মানুষকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী, ব্রিটিশরাজের উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লস, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কেউই করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না।

পৃথিবীর প্রায় ৭৭৭ কোটি জনসংখ্যার সবাই আক্রান্তের অবস্থায় আছে, যা স্মরণকালের কোনো বিপর্যয়ে দেখা যায়নি। তারপরও আশা করি, মানুষের নতুন নতুন আবিষ্কার, সুরক্ষা পদ্ধতির উদ্ভাবন ও সচেতনতায় একদিন আমরা করোনাকেও জয় করতে পারব। মানুষের প্রজ্ঞা ও প্রত্যয়ের ওপর আমার এখনও দৃঢ় আস্থা রয়েছে। তবে দেখার বিষয় হল, তা কতটা ‘খেসারতের’ (Price) বিনিময়ে হবে।

উল্লিখিত মহামারীর সঙ্গে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কিছুটা ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। আগেকার মহামারীগুলোতে মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে বটে; মানুষের অসহায়ত্বের প্রকাশ ঘটেছে নিশ্চিত, তবে সমাজমানসিকতার পরিবর্তনের আশঙ্কা জাগেনি। করোনাভাইরাসের আক্রমণে ভবিষ্যৎ বিশ্বব্যবস্থা পাল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেকই দেখছেন। এর সবই যে ষোলআনা যৌক্তিক তা নয়, তবে নিশ্চয়ই তা আলোচনার এবং নতুন করে ভাবার অবকাশ রাখে।

কেউ কেউ বলছেন, করোনা ‘বিশ্বায়নের’ ধারণাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। কারণ হিসেবে সামনে এনেছেন সব রাষ্ট্রের একে অপরের থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে। খোদ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও একত্রে কাজ করতে পারেনি। কিন্তু আমার ধারণা, এর সঙ্গে বিশ্বায়নের কোনো সম্পর্ক নেই। করোনাভাইরাস শুধু রাষ্ট্রগুলোকে পৃথক করেনি, রাষ্ট্রের ভেতরে থাকা অঞ্চল, অঞ্চলের ভেতরে থাকা সমাজ, সমাজের ভেতরে থাকা পরিবার, এমনকি পরিবারের ভেতরে থাকা সদস্যদেরও পৃথক করে ফেলেছে। এ আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার আর কোনো উপায় ছিল না।

সুতরাং সামাজিক দূরত্ব তৈরি করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে রোগের প্রকৃতির কারণে। ‘বিশ্বায়ন যেসব কারণে আক্রান্ত হয় তার একটি হল এটি ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ ও ধারার অবমূল্যায়িত করে। সংঘাত কিন্তু বাস্তবসম্মত এবং বলতে গেলে তা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, যা কিনা বিশ্বায়ন দ্বারা অনুসৃত, ফল দিচ্ছে নগরায়ণ ঘটিয়ে, ভেঙে যাচ্ছে গতানুগতিক সমাজব্যবস্থার মৌলিকত্ব’ (জোসেফ ই স্টিগলিজ; ‘গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকন্টেন্টস’; পৃষ্ঠা: ২৯১)। বিশ্বায়ন হল একটি বাণিজ্যিক সম্পর্ক। বড় পুঁজি তার স্বার্থ রক্ষার খাতিরেই পণ্যের বাজার উন্মুক্ত করেছে, শ্রমবাজার নয়। বিশ্বায়ন কখনোই মানুষে-মানুষে মেলবন্ধন তৈরির লক্ষ্যে সৃষ্টি হয়নি। পুঁজির শোষণকে দৃঢ় ও পাকাপোক্ত করতেই এ ধারণার জন্ম। সুতরাং ধনী ও গরিব রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ সমভাবে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যর্থতাই বিশ্বায়নের জন্য ‘চ্যালেঞ্জ’, করোনা নয়।

অনেকেই ভাবছেন, আগামী দিনগুলোয় মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়তে পারে। এ বিষয়ে আমেরিকার জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেবরাহ ট্যানেন মনে করেন, ‘‘কারও সঙ্গ পেলে বা কাছে এলে এখন যে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, তার বদলে অনুপস্থিতিতেই হয়তো বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব। এখন যেমনটি আমরা বলি, ‘এসব কথা কি অনলাইনে বলা ঠিক হবে?’, এর পরিবর্তে হয়তো আমরা বলতে শুরু করব, ‘এসব কথা সাক্ষাতে বলার কি কোনো দরকার আছে?’ অনিচ্ছাকৃত হলেও সত্য হচ্ছে, ব্রডব্যান্ডের সুবিধা যাদের থাকবে না, তারা আরও বেশি বঞ্চিত হবে। অনলাইনের বিষয়টি আরও ব্যাপকতর হবে। এতে করে যোগাযোগ জোরদার হলেও মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়বে।’’ সামাজিক জীব হিসেবে এ সত্য মেনে নেয়া কষ্টকর হলেও বাস্তবতাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না।

লোক সমাগমের প্রতি মানুষের ভয় দীর্ঘায়িত হলে বাজারব্যবস্থা পাল্টে যেতে পারে। আমরা যে রমরমা শপিংমলগুলো দেখছি তার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যেতে পারে; বেড়ে যেতে পারে ই-কমার্সের দাপট। শপিংমলের ভিড় এড়াতে মানুষ অনলাইনে বাজার করাটাকে অনেক বেশি নিরাপদ বলে মনে করতে পারে। কাঁচাবাজারও এর আওতায় চলে আসবে বলে অনেকের ধারণা। করোনাভাইরাস ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রের চরিত্র পাল্টে দিতে পারে। উৎপাদন ব্যবস্থায় সরাসরি শ্রমের বিকল্প খোঁজা হতে পারে। গবেষক আলতাফ পারভেজের মতে, ‘ভাইরাস-ঝড় থামার পরই পুঁজি তার পুনরুত্থানের জন্য অটোমেশনের ওপর জোর দেবে এবার। কারখানা ও সাপ্লাই চেইন দুটোর অটোমেশন করা গেলে হবু ভাইরাস যুদ্ধগুলোকে এড়ানো সহজ হতে পারে। অটোমেশন যুগের ব্যাপকতা বাংলাদেশের মতো শ্রমজীবীনির্ভর দেশগুলোর জন্য খারাপ খবর।’

‘পরাশক্তি’ বা ‘সুপার পাওয়ার’ ধারণার পরিবর্তন হতে পারে। আমরা পরাশক্তি বলতে বর্তমানে মারণাস্ত্র তৈরির ও অধিকারীর ক্ষমতাকে বুঝি। কিছুদিন আগেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, আমরা ২ ট্রিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশের চলতি বাজেটের প্রায় ৪০ গুণ) এমনি এমনি বিনিয়োগ করিনি। তিনি অস্ত্রের ভাণ্ডার বিবেচনায় নিয়ে অমন দম্ভোক্তি করেছিলেন। আজকে যুক্তরাষ্ট্র যখন করোনাভাইরাসে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত, তখন ট্রাম্পের মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এটা আজ পরিষ্কার, করোনাভাইরাসের কাছে ওই অস্ত্রের কোনো ক্ষমতা নেই। তাই শক্তিধর দেশ বলতে ভবিষ্যতে মানুষ মহামারী প্রতিরোধের ক্ষমতাকেই বুঝবে। মানুষ বুঝতে শিখবে, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন অর্থ ব্যয় করে মানুষের জীবন কেড়ে নেয়ার চেয়ে মহামারিতে মানুষের জীবন রক্ষা করাটা অনেক বেশি দায়িত্বের পরিচায়ক।

পৃথিবীর সরকারগুলোর কাছে চিকিৎসা খাতে আরও বেশি মনোযোগী হওয়ার তাগিদ এসেছে করোনাভাইরাস থেকে। যদি আমেরিকার কথা বলি তাহলে রুজভেল্ট ইন্সটিটিউটের অ্যাডভোকেসি ও পলিসিবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট স্টেফ স্টার্লিংয়ের বক্তব্য হল, ‘ওষুধ ও ভ্যাকসিনের উন্নয়ন, গবেষণা ও উৎপাদনের ব্যয়বহুল, অকার্যকর ও বাজারকেন্দ্রিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিয়েছে করোনাভাইরাস। গত ২০ বছরে করোনাভাইরাস গোত্রের বেশ কয়েকটি ভাইরাস হানা দিয়েছে, এর মধ্যে কোভিড-১৯ একটি। এর যে প্রতিষেধক বের করা গেল না, এর পেছনে সরকারের ব্যর্থতা আছে।

কারণ, সরকার নিজে উদ্যোগী হওয়ার বদলে ওষুধ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগকে অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আর এ কারণেই আমাদের ১৮ মাস অপেক্ষা করতে হবে- কখন বেসরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সফল হবে। আর মুনাফার নিশ্চয়তা না পেলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জনস্বার্থ সম্পর্কিত ভবিষ্যৎ সংকটের কথা মাথায় রেখে কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হবে না।’ সুতরাং দূর ভবিষ্যতের বিপদকে মোকাবেলার স্বার্থে গবেষণা কাজে সরকারগুলোকে অধিকতর মনোযোগী ও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের কথা ভাবতে হবে। আলোচিত পরিবর্তনের ইঙ্গিতগুলো বাস্তবতার নিরিখেই তৈরি। তবে এটি যেহেতু তথ্যনির্ভর অনুমান, তাই এর শতভাগ প্রতিফলন না-ও ঘটতে পারে; কিন্তু শতভাগ উপেক্ষা করার সুযোগ আছে কি?

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

SHARE