ইভিএমে ট্রায়ালেই নানা বিপত্তি, নির্বাচন কর্মকর্তারাও চালাতে পারছেন না

ইভিএমে মক ভোটিংয়েই নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। ছবিটি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রেসিডেনসিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে তোলা। বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি। ছবি : পিবিএ

রূপান্তর রিপোর্ট: দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি সত্ত্বেও ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন)-এ ভোট নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

এর আগে ছোট ছোট পরিসরে বিভিন্ন এলাকায় ইভিএমে ভোট হলেও বড়ো পরিসরে এবারই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে এ পদ্ধতিতে ভোট হবে।

এজন্য নির্বাচন কমিশন বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত রাজধানীর সবগুলো কেন্দ্রে ট্রায়াল (মক) ভোট নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

তবে রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্রে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গিয়েছে, ইভিএমে নানা জটিলতার বিষয়। এমননকি নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তারাই ইভিএম মেশিন সঠিকভাবে চালাতে পারছেন না। আবার কোনো ধরনের গড়বড় হলে কীভাবে ঠিক করা যাবে তার কোনো প্রশিক্ষণ নেই তাদের।

পাশাপাশি বিদ্যুত্ নিয়ে এক ধরনের শঙ্কার কথাই প্রকাশ করেছেন অনেকে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, প্রথমদিকে ইভিএমে ত্রুটি থাকলেও এবার প্রস্তুতি বেশ ভালো আছে।

এদিকে ইভিএমে প্রতিটি কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসারদের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাধারণ ভোটাররাই। প্রতিটি কেন্দ্রে ভোটারদের আঙুলের ছাপ না মিললেও প্রিজাইডিং অফিসার শতকরা এক ভাগ ভোটারকে ভোট দেওয়ার সুযোগ দিতে পারবেন। প্রয়োজন মনে করলে, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে এই ভোটের সংখ্যা আরো বাড়িয়েও নিতে পারবেন। এখন প্রিজাইডিং অফিসাররা এই সুযোগ কাদের দেবেন বা কীভাবে দেবেন সেটা নিয়েও অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এছাড়া তারা এই সংখ্যা বাড়িয়ে নিলেও কেউ জানতে পারবে না বলে মনে করেন তারা।

রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্রে ইভিএমের মক ভোট দিতে আসা অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা বলেছে রূপান্তর টিম। নির্বাচন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্যতা করতে বেশিরভাগ ভোটারই এটি বন্ধ রাখার পক্ষেই মত দিয়েছেন।

উত্তর মুগদাপাড়া থেকে দক্ষিণ মুগদাপাড়ার কাজী জাফর আহমেদ উচ্চবিদ্যালয় প্রদর্শনীতে এসে ব্যবসায়ী এ কে আজাদ অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে ইভিএম ভোটিং দেখে নিজে চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ‘যা দেখলাম, তাতে জটিল মনে হয়েছে। আমি বুঝি নাই। আমি তো তাও একটু শিক্ষিত, যারা অশিক্ষিত তারা তো আরো বুঝব না।’

রাজধানীর শুক্রাবাদের নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, নিচ তলায় নারী ভোটারদের কক্ষে ইভিএম সেটই করা হয়নি। ওই কেন্দ্রের তৃতীয় তলায় পুরুষ ভোট কক্ষে মেশিন বসানো হয়েছে। কিন্তু সেটি ঠিকমতো কাজ করছিল না। বারবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। ওই কক্ষের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা হন্যে হয়ে অন্য কক্ষের কর্মকর্তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। কেন বারবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তা ওই কর্মকর্তা বুঝতে পারছিলেন না। একজন বয়স্ক ভোটার একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে চলে যান।

বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে শুক্রাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতা কয়েকজন নারী ভোটারকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন।

ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ফায়াদ হোসেন বলেন, ‘আমরা একবারই প্রশিক্ষণ নিয়েছি। কাজটা খুবই সহজ। কিন্তু মেশিন গড়বড় বলে ঝামেলাতে পড়তে হবে। আমরা ঠিকমতো চালু করতে পেরেছি। আশা করি, ঝামেলা হবে না।’

কেন্দ্রে ভোট দিতে যাওয়া নারী ভোটাররা হাতের ছাপ দিয়েই ভোট দিয়েছেন। তাদের ঝামেলা না হলেও অনেকেই শঙ্কার কথা বলেছেন।

এদিকে শুক্রবার প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইভিএমে ভোটপ্রদান নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ভোটাররা। তারা বলছেন, কন্ট্রোল ইউনিটে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়ার পর ব্যালট ইউনিটে যে কোনো গোপন বুথে ঢুকে ভোট দিয়ে যেতে পারেন। এজন্য ব্যালট ইউনিটে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংযুক্ত করা উচিত ছিল। এছাড়াও ইভিএমের প্রদর্শনীতে এসে ভোটদান সহজ হওয়ার কথা অনেকে বললেও কারো কাছে তা ঠেকেছে জটিল।

ইভিএমের বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ বলেন, ইভিএমে ভোটদানের পর ভোটার কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারেন না। কেননা কোন প্রতীকে ভোটারের ভোট পড়েছে তা যাচাই-বাছাই করার সুযোগ নেই। তবে প্রিজাইডিং অফিসারের হাতে প্রদত্ত ফিঙ্গার ম্যাচিং ক্ষমতা বন্ধ করা।

আব্দুর রহিম নামে একজন ভোটার জানান, ভোটকেন্দ্র দখল হলে ইভিএমও নিরাপদ নয়। সেক্ষেত্রে ইভিএমে পড়তে পারে জালভোট। ইভিএমের দুটি ইউনিট। একটি কন্ট্রেল ইউনিট এবং অন্যটি ব্যালট ইউনিট। এর মধ্যে ব্যালট ইউনিটটি অরক্ষিত। কন্ট্রোল ইউনিটে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচিংয়ের পর গোপনকক্ষে সংরক্ষিত ব্যালট ইউনিটে গিয়ে একজনের ভোট দিতে পারেন অন্যজন। ফলে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

ইভিএমের প্রকল্প পরিচালক কর্নেল কামাল উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুই সিটি ভোটে প্রায় ৩৫ হাজার ইভিএম মেশিনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ২৮ হাজারের মতো ইভিএম মেশিন সরাসরি ভোটকেন্দ্রগুলোতে ব্যবহার করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বাকিগুলো বিকল্প হিসেবে রাখা হয়েছে। এছাড়া ইভিএমের টেকন্যিকাল সাপোর্টের জন্য প্রতিটি কেন্দ্রে সেনাবাহিনীর দুই জন করে টেকনিক্যাল সদস্য মোতায়েন থাকবে। বিগত সময়ে ইভিএমে ভোটের রেজাল্ট আসতে দেরি হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এবার এই সমস্যা আর হবে না। দ্রুত রেজাল্ট পাওয়া যাবে।

তারপরও সুষ্ঠু ভোটে আশাবাদী সিইসি!

ইভিএম নিয়ে ভালো প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। তিনি বলেন, ‘প্রথমবার (জাতীয় সংসদ নির্বাচনে) ইভিএমে অনেক ত্রুটি ছিল। এরপর সেগুলো সংশোধন করে আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি।’

বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে অনুষ্ঠিত ‘ইভিএমে মক ভোটদান প্রদর্শনী অনুষ্ঠান’ পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।

আরও পড়ুন

ইভিএমের অনুশীলন ভোটে সাড়া দেননি ভোটাররা

SHARE